ঈদ উল ফিতর – এর তৃতীয় দিন ।বাবা আর আমি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল হসপিটালের মেডিসিন বিভাগে। বাবা ২৬শে রমজান রাতে ষ্ট্রোক করেন। এখন পর্যন্ত পুরোপুরি সুস্থ না। ডাক্তার তাকে সিসিইউ থেকে সাধারণ বিছানায় দিলেন আজ সকালে।
রাত ১২.৩০ মিনিটঃ বাবা বিছানায় শুয়ে আছেন। আর আমি বসে “উত্তারাধীকারী” পড়ছি। সুনশান নিরবতায় চারপাশ। প্রায় ত্রিশ জনের ধারন ক্ষমতাসম্পন্ন এই ঘরটাতে এখন মাত্র তিন জন রুগী। সবাই গভীর ঘুমে। রাতের গভীরতার সাথে সাথে বাড়ছে নিরবতা। মশার চড়ুইভাতি রাতের অন্যতম অবিচ্ছেদ্য অংশ।
রাত ১.২০ মিনিটঃ উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রের সাথে নিজের জীবনের চরিত্রগুলোকে বিন্যস্ত করছিলাম। মাঝে মাঝেই হারিয়ে যাচ্ছি্লাম। হঠাৎ চারপাশে গুমোট শব্দের গুঞ্জন শুরু হলো। গুঞ্জন আস্তে আস্তে আরো জোরালো হচ্ছে। ধীরে ধীরে তা রীতিমত চিৎকার, চেঁচামেচিতে পরিনত হলো। উঠে এগিয়ে গেলাম ওয়ার্ডের দিকে। রুগীর সংখ্যা বাড়ছে। মনে হচ্ছে ঈদের ছুটির পর তারা ঘরে ফিরছে। একজনের পর একজন … বেড়েই চলছে সময় এর সাথে পাল্লা দিয়ে। অল্প কিছু সময়ে ভরে গেলো প্রতিটি বিছানা। পর্যাপ্ত বিছানার অভাবে বারান্দায় আশ্রয় পেল বেশ কিছু মুমুর্ষ রুগী। চারপাশের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে পরিবেশ ভয়ংকর হতে লাগলো ক্রমশ।
রাত ২.৪০ মিনিটঃ চারপাশে রুগীদের কান্নাকাটি আর হাত পা ছুড়াছুড়ি, স্বজনদের আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠছে। কোথাও আবার খিস্তি খেউরে ডাক্তার, হাসপাতাল অথবা সিষ্টেমের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার হচ্ছে। একজন মাত্র ডিউটি ডাক্তার। বাকিরা সবাই ছুটিতে । গোটা কয়েক ইন্টার্নি ডাক্তার আর কিছু নার্স হিমশিম খাচ্ছে পরিপুর্ণ সেবা দিতে। তারপরও সর্বাত্মক চেষ্টা তাদের, একটা জীবন ও যাতে না হারায়। নাহ!!! আর বসে থাকা সম্ভব না। এভাবে বসে থাকাটা বাঞ্ছনীয় নয়। নেমে পড়লাম, যদি কোন সহযোগিতা করা যায়। বেশকিছু ডাক্তার বন্ধুদের কল্যানে ডিউটি ডাক্তার,ইন্টার্নি ডাক্তারদের সাথে সখ্যতা ছিল আগে থেকেই। সেটাকে কাজে লাগিয়ে নেমে পড়লাম নিজেই। কাকে রেখে কার দিকে এগিয়ে যাব, রীতিমত হ-য-ব-র-ল অবস্থা। এর মাঝে জীবন মৃত্যুর সন্ধিখনে আছে চারজন।জ়ীবনের মায়া ত্যাগ করার জন্য একজন বিষ, দুই জন কীটনাশক আর একজন হারপিক পান করে অসুস্থ হয়ে লড়াই করছে জীবনকে ফিরে পেতে। আমি ভাবছি একজন মানুষ কিভাবে হারপিক পান করলো !!! বিষ , কীটনাশক এর কথা না হ্য় মেনে নিলাম কিন্তু তাই বলে “হারপিক” !!! কিভাবে সম্ভব ? তাও একজন মেয়ে !!! সাত পাঁচ ভেবে এখন কোন লাভ নেই। দ্রুত তাদের সেবা করতে হবে। পেট ওয়াশ করতে হবে। জীবন বাচাঁতে হবে। হিমশিম খাচ্ছি কাকে রেখে কার টা আগে শুরু করা হবে। বিষ পান করেছিল ষোল সতের বছরের একটি ছেলে। ছেলেটির আর্তচিৎকার আর স্বজনদের আতংকগ্রস্থ চেহারা আমাকে ব্যাকুল করে দিচ্ছে। আমি কিছু করতে পারছিনা কারও জন্য। বার বার মনে হচ্ছিলো আমার যদি কোন ঐশ্বরিক ক্ষমতা থাকতো তাহলে তার যন্ত্রনা লাঘব করার চেষ্টা করতে পারতাম। সবগুলো রুগীকে সুস্থ করে তুলতাম চোখের পলকে। বাবার কথাও বার বার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। যদি তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম থেকে উঠে এই ভীতিকর পরিস্থিতি সহ্য করাটা তার জন্য খুবই পীড়াদায়ক হবে। সকল চিন্তার মধ্যে বাবার চিন্তাটা আমার কাছে মুখ্য। এক্ষেত্রে কিছুটা স্বার্থপরও আমি। কারন বাবা সেতো আমার “বটগাছ”। যার ছায়ায় আশ্রয় না পেলে জীবনযুদ্ধে নামার কোন রসদ পেতাম না। জ়ীবনের চলার পথের সকল পদক্ষেপে আমি তাকে অনুসরন করার আপ্রান চেষ্টা করি। কিছুটা সংকিত মনে বাবার বিছানার সামনে এসে দাড়ালাম। আহ !!! ৭.৫ মি.গ্রা. এর একটা মাইলাম খেয়ে আমার বাবা ঘুমুচ্ছেন। আসস্ত হয়ে ফিরে এলাম রুগীদের কাছে। ইতিমধ্যে ক্যাথেডার, নল এবং আরো বেশ কিছু ঔষধ আনা হয়েছে। ছেলেটি হাতপা ছুড়ছে, কোনভাবেই সে ক্যাথেডার লাগাতে দিবে না। আমরা চার জনে তাকে চেপে ধরলাম। কিন্তু তাকে ধরে থাকা খুবই কষ্টকর ছিল। ছেলেটির কষ্ট দেখে তার মা সামনে থেকে সরে গেলেন। একবার বিষ পান করার পর কারও পেট ওয়াশ করা কতটুক কষ্টের ! আমি নিশ্চিত কেউ যদি তা জানতো তাহলে ভুলেও কোনদিন অন্তত বিষ পান করে আত্মাহুতি দিতো না!!! আমি তো ছেলেটিকে দেখে অনুধাবন করার চেষ্টা করেছি মাত্র, কিন্তু ছেলেটি হারে হারে টের পেয়েছে “কত ধানে কত চাল”। জানতে পারলাম ছেলেটি বাবা মার সাথে অভিমান করে বিষ খেয়েছে । কিইবা তার দুঃখ ছিল ? হয়ত বাবা তাকে দামী পোষাক কিনে দিতে পারেননি ! হয়ত মা তার জন্য ভাল কিছু রান্না করেননি ! হয়ত বাজে বন্ধুদের সাথে বাইরে যেতে দেননি ! যতটুকু কষ্ট নিয়ে ছেলেটি বিষ খেয়েছে তার থেকে শতগুন বেশী কষ্ট সে রাতে সে পেয়েছে। ছেলে তোমার এই ছোট্ট একটা ভুল তোমার বাবা মা কে কি কষ্ট না দিল ! আশে পাশের সবাই ছিল চিন্তিত । এই তিন ঘন্টায় কি কি যে ঘটে গেল তার অনেক কিছুই তুমি জানতে পারবে না । তোমার চারপাশের ভালবাসার মানুষগুলোও কোনদিন তোমাকে বুঝতে দিবে না। আমাদের সবারই কোন না কোন পিছুটান থাকেই। কমতি আছে সবারই। তাই বলে হার মেনে জীবন নিয়ে আক্ষেপ করে লাভ কি ? জীবনকে সাজাতে হবে নতুন উদ্দ্যমে। একে একে চারজনকে পরিপূর্ণ সেবা দেয়া হল। আমি সেই মেয়েটির সামনে যাইনি। সেই হারপিক খেকো ! কেনো জানি তার কথা মনে হওয়া মাত্র আমার শুধু কমোড এর কথা মনে পড়ছিলো। আমি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম কার কি অবস্থা? সবাইকে যথা সা্ধ্য সেবা দেয়া হয়েছে, সবাই বিপদমুক্ত।
সকাল ৬.৩০ মিনিটঃ বারান্দায় এসে দাড়ালাম। সকালের মিষ্টি রোদ ঝিকমিক করছে। এমন এক রাতের পর সকালের এই স্নিগ্ধতা আমাকে মুগ্ধ করে দিলো। আস্তে আস্তে এগিয়ে এলাম বাবার বিছানার দিকে। এখন ও ঘুমুচ্ছেন, একেবারে যেন ছোট্ট এক নিষ্পাপ শিশু। বিছানার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকলাম বেশ খানিকখন। হঠাৎ চোখ মেলে বললেন – “কিরে ব্যাট্যা, সারারাত ঘুমাস নাই ? আমারতো শরীর খারাপ আমার সাথে সারা রাত জেগে থাকলে তো আমার পাশে আরেকটা বিছানা তোর জন্যও দিতে হবে !!!”
রাতের সকল ক্লান্তি নিমেষে উবে গেল কর্পূর এর মত।আরও একটি নতুন দিন শুরু করার উজ্জীবনী শক্তি আমি পেয়ে গেলাম।
এই তো জীবন। এই তো আনন্দ। সব থেকে বড় পাওয়া।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফেরদৌস রহমান
: প্রথম লিখলাম, তাই আগে থেকেই একটা ভাললাগা ছিল। তার উপর বোনাস আপনাদের সকলের প্রেরণা !!! আরো ভালভাবে লেখার জন্য অনুপ্রাণিত করে তুলছে দিন দিন। সবার কাছে সামনে এগিয়ে যেতে সহযোগিতা চাই। সবাই ভাল থাকবেন।
ঝরা পাতা
নিজে হাসপাতালে কাজ করি তাই এই ধরনের অভিজ্ঞতা প্রায়ই হয়...অনেক ধন্যবাদ আপনাকে মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য...আর বাস্তবধর্মী গল্পটির জন্য অভিনন্দন। :)
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।